কিভাবে যাওয়া যায়:
ঢাকার খুবই নিকটবর্তী জেলা
হচ্ছে মুন্সীগঞ্জ। অতীশ দীপঙ্করের
পণ্ডিত ভিটা ও অডিটরিয়ামটি অবস্থিত রয়েছে মুন্সীগঞ্জ
সদর উপজেলার বজ্রযোগিনী ইউনিয়েনের বজ্রযোগিনী গ্রামে । ঢাকা থেকে মুন্সীগঞ্জের দূরুত্ব
২৩ কিলোমিটার মাত্র এটি সড়কপথের হিসাব কিন্তু নৌ পথে আরও দ্রুত যাওয়া যায়।
তবে আরো ০৬ কিলোমিটার
দক্ষিণ-পশ্চিমে এসে তার পর যেতে হবে অতীশ দীপঙ্করের পণ্ডিত
ভিটা ও অডিটরিয়াম দেখার
জন্য।
কিন্তু একদিনেই সম্ভব ঢাকা থেকে খুব ভোরে এসে এটি দেখেই বিকেল বিকেলের
মধ্যেই ঢাকায় ফিরে যাওয়া যাবে। কষ্ট হবে না সড়কপথে
যেতে । তবে
নৌপথে গেলে সময়ও বাচঁবে
এবং যানজট এড়িয়ে নদী
পথের সৌন্দর্য অবগাহন করে সাচ্ছন্দের
সাথে পৌছানো যাবে।
সদর ঘাট থেকে মুন্সীগঞ্জগামী যে কোন লঞ্চে উঠেই মাত্র ২ ঘন্টার মধ্যেই
পৌছে যেতে পারেন মুন্সীগঞ্জ
লঞ্চ ঘাটে। মুন্সীগঞ্জ
সদর উপজেলা হইতে রিক্সা
/ টেম্পু তে উঠেই চলে আসতে পারেন অতীশ দীপঙ্করের
পণ্ডিত ভিটায়।
রিক্সা ভাড়া ৪০-৫০
টাকা।
একজন প্রখ্যাত পণ্ডিত
যিনি পাল সাম্রজ্যের আমলে
একজন বৌদ্ধ ভিক্ষু এবং
বৌদ্ধধর্মপ্রচারক ছিলেন তিনিই হলেন অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান।
জন্ম
অতীশ দীপঙ্কর জন্মগ্রহণ করেন ৯৮২ খ্রিষ্টাব্দে বিক্রমপুর
পরগনার বজ্রযোগিনী গ্রামে । বর্তমানে এটি বাংলাদেশের খুবই বিখ্যাত গ্রাম বিক্রমপুরের মুন্সিগঞ্জ জেলার অন্তর্ভুক্ত।
'পণ্ডিত
ভিটা' নামে অতীশ দীপঙ্করের বাসস্থানটি এখনও পরিচিত।
অতীশ দীপঙ্কর গৌড়ীয় রাজ পরিবারে সামন্ত রাজা
কল্যাণশ্রী ও ঔরসে
প্রভাবতী দেবীর গর্ভে
সন্তান হিসেবে জন্মগ্রহণ করেছিলেন।
শৈশব
তার আর একটি নাম ছিল
আদিনাথ চন্দ্রগর্ভ ছোটবেলায় তাকে সবাই এই নাম বলেই ডাকত। তিন
ভাইয়ের মধ্যে তিনি ছিলেন
দ্বিতীয়। পদ্মগর্ভ ও শ্রীগর্ভ নাম
ছিল তার
অপর দুই ভাইয়ের। তিনি খুব অল্প বয়সে
বিয়ে করেন। লোক কথায় জানা যায় তার পাঁচ স্ত্রীর ছিলেন এবং মোট ৯টি পুত্র
সন্তান জন্মগ্রহণ করেন এই পাঁচ স্ত্রীর
গর্ভে।
কিন্তু কোন পুত্রেরই নাম বা কোন খবর পাওয়া যায়নি শুধু পুন্যশ্রী নামে একটি পুত্র ছাড়া।
শিক্ষা
তার মায়ের কাছ থেকে প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করেন। যে বয়সটিতে কথা ঠিক মত বলতে পারেনা সেই বয়সে তিনি মাত্র তিন
বছর বয়সে সংস্কৃত ভাষায়
পড়তে শেখেন এবং দশ
বছর বয়সে তিনি বৌদ্ধ ও
অবৌদ্ধ শাস্ত্রের পার্থক্য বুঝতে পারেন এই বিরল
প্রতিভাগুলো তার মধ্যে প্রদশিত ছিল। তিনি নালন্দায় শাস্ত্র
শিক্ষা করতে যান মহাবৈয়াকরণ বৌদ্ধ পণ্ডিত জেত্রির
পরামর্শ অনুযায়ী।
নালন্দায় আচার্য বোধিভদ্র নামের একজন ভিক্ষু ১২ বছর বয়সে গুরুর শিষ্যত্ব গ্রহণ করায় অতীশকে
শ্রমণ রূপে দীক্ষা দেন
এবং তার নাম দেন দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান তখন থেকে তাঁর
নাম হয় দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান। তিনি বোধিভদ্রের গুরুদেব
অবধূতিপাদের নিকট সর্ব শাস্ত্রে
পান্ডিত্য অর্জন করেন ১২
থেকে ১৮ বছর বয়স
পর্যন্ত ।
তিনি বিক্রমশীলা বিহারের
উত্তর দ্বারের দ্বারপন্ডিত নাঙপাদের নিকট তন্ত্র শিক্ষা
করেন ১৮ থেকে ২১ বছর
বয়স পর্যন্ত । মহা সাংঘিক
আচার্য শীলরক্ষিতের কাছে উপসম্পদা দীক্ষা
গ্রহণ করেন এরপর
মগধের ওদন্তপুরী বিহারে। তিনি পশ্চিম
ভারতের কৃষ্ণগিরি বিহারে গমন করেন
ধর্মীয়
জ্ঞানার্জনের জন্য এবং সেখানে তিনি প্রখ্যাত পন্ডিত
রাহুল গুপ্তের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন।
‘গুহ্যজ্ঞানবজ্র উপাধিতে
ভূষিত হন বৌদ্ধ শাস্ত্রের আধ্যাত্নিক গুহ্যাবিদ্যায় শিক্ষা গ্রহণ করে।
শতাধিক
শিষ্যসহ মালয়দেশের সুবর্ণদ্বীপ (বর্তমানে ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা দ্বীপ) গমন করেন
দীপঙ্কর ১০১১ খ্রিস্টাব্দে এবং দীর্ঘ ১২ বছর বৌদ্ধ
দর্শনশাস্ত্রের বিভিন্ন বিষয়ের উপর অধ্যয়ন করে আচার্য ধর্মপালের কাছে। তিনি বিক্রমশীলা বিহারে অধ্যাপনার দায়িত্বভার
গ্রহণ করেন স্বদেশে ফিরে আসার পর।
তিব্বত যাত্রা
তিব্বতের সম্রাট ল্হ-লামা-য়েশো কয়েক জন
দূতের হাতে প্রচুর স্বর্ণ
উপঢৌকন দিয়ে দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞানকে
তিব্বত ভ্রমনের আমন্ত্রন জানালে দীপঙ্কর সবিনয়ে
তা প্রত্যাখ্যান করেন। এতে
নিরাশ না হয়ে সম্রাট
সীমান্ত অঞ্চলে সোনা সংগ্রহের
জন্য গেলে গরলোগ অঞ্চলের
অধিপতি তাঁকে বন্দী করেন
ও প্রচুর সোনা মুক্তিপণ
হিসেবে দাবী করেন।
সম্রাট তাঁর পুত্র লহা-লামা-চং-ছুপ-ও কে মুক্তিপণ
দিতে বারণ করেন এবং
ঐ অর্থ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞানকে
তিব্বতে আনানোর জন্য ব্যয়
করতে বলেন। লহা-লামা-চং-ছুপ-ও সম্রাট হয়ে
গুং-থং-পা নামে
এক বৌদ্ধ উপাসককে ও
আরো কয়েক জন অনুগামীকে
দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞানকে তিব্বতে আনানোর দায়িত্ব দেন। এরা
নেপালের পথে বিক্রমশীলা বিহারে
উপস্থিত হন এবং দীপঙ্করের
সাথে সাক্ষাৎ করে সমস্ত সোনা
নিবেদন করে ভূতপূর্ব সম্রাট
ল্হ-লামা-য়েশোর বন্দী
হওয়ার কাহিনী ও তাঁর
শেষ ইচ্ছার কথা ব্যক্ত
করলে দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান অভিভূত হন।
আঠারো মাস পরে ১০৪০
খৃস্টাব্দে বিহারের সমস্ত দায়িত্বভার লাঘব
করে দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান তিব্বত যাত্রার জন্য
প্রস্তুত হন। তিনি
দোভাষী সহ বারো জন
সহযাত্রী নিয়ে প্রথমে বুদ্ধগয়া
হয়ে নেপালের রাজধানীতে উপস্থিত হন এবং নেপালরাজের
আগ্রহে এক বছর সেখানে
কাটান। এরপর
নেপাল অতিক্রম করে থুঙ বিহারে
এলে তাঁর দোভাষী ভিক্ষু
গ্য-চোন-সেঙ অসুস্থ
হয়ে মারা যান।
১০৪২ খৃস্টাব্দে তিব্বতে র পশ্চিম প্রান্তের
ডংরী প্রদেশে পৌছন। সেখানে
পৌছলে লহা-লামা-চং-ছুপ-ও এক
রাজকীয় সংবর্ধনার আয়োজন করে তাঁকে
থোলিং বিহারে নিয়ে যান। এখানে
দীপঙ্কর তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ
বোধিপথপ্রদীপ রচনা করেন।
১০৪৪ খৃস্টাব্দে তিনি পুরঙে, ১০৪৭
খৃস্টাব্দে সম-য়ে বৌদ্ধ
বিহার ও ১০৫০ খৃস্টাব্দে
বে-এ-বাতে উপস্থিত
হন।
তিব্বতে বৌদ্ধ ধর্মের প্রসার
তিনি ভ্রমণ করেন
তিব্বতের বিভিন্ন অংশ এবং বৌদ্ধ ধর্মের ব্যাপক
সংস্কার সাধনও করেন।তিব্বতী বৌদ্ধধর্মে প্রবিষ্ট তান্ত্রিক পন্থার অপসারণের চেষ্টা করেন তিনি বিশুদ্ধ মহাযান মতবাদের প্রচার
করেন। তিব্বতে কদম-পা নামে
এক লামা সম্প্রদায়ের সৃষ্টি
করেন তিনি।
রচনা
দুই শতাধিক গ্রন্থ
রচনা, অনুবাদ ও সম্পাদনা
করেন দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান।বিশাল এক শাস্ত্রগ্রন্থ সংকলন করেন তিনি।নাম হলো তিব্বতের
ধর্ম, রাজনীতি, জীবনী, স্তোত্রনামাসহ তাঞ্জুর
। তিনি তিব্বতী আরও অনেক ভাষায় বৌদ্ধ
শাস্ত্র লিখেন। যেম:, চিকিৎসা বিদ্যা এবং কারিগরি
বিদ্যা বিষয়।তিব্বতীরা তাই তাকে ভূষিত করে অতীশ উপাধীতে । তিব্বতী ভাষায় অনুবাদ করেন অনেক সংস্কৃত এবং পালি বই অতীশ
দীপঙ্কর । দীপঙ্করের
রচিত গ্রন্থগলির মধ্যে বোধিপথপ্রদীপ, চর্যা-সংগ্রহপ্রদীপ, সত্যদ্বয়াবতার, মধ্যমোপদেশ, সংগ্রহগর্ভ, হৃদয়-নিশ্চিন্ত, বোধিসত্ত্ব-মণ্যাবলী, বোধিসত্ত্ব-কর্মাদিমার্গাবতার, শরণাগতাদেশ, মহযান-পথ-সাধন-বর্ণ-সংগ্রহ, শুভার্থ-সমুচ্চয়োপদেশ, দশ-কুশল-কর্মোপদেশ,
কর্ম-বিভঙ্গ, সমাধি-সম্ভব-পরিবর্ত,
লোকোত্তর-সপ্তকবিধি, গুহ্য-ক্রিয়া-কর্ম,
চিত্তোৎপাদ-সম্বর-বিধি-কর্ম,
শিক্ষাসমুচ্চয়-অভিসময় ও বিমল-রত্ন-লেখনা উল্লেখযোগ্য। বিখ্যাত পন্ডিত
হরপ্রসাদ শাস্ত্রী এবং ইতালির বিখ্যাত
গবেষক টাকি দীপঙ্করের অনেকগুলো
বই আবিস্কার করেন।
মৃত্যু
তিব্বতে বৌদ্ধ ধর্মে সংস্কারের
মতো শ্রমসাধ্য কাজ করতে করতে
দীপঙ্করের স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটলে ১০৫৪
খৃস্টাব্দে ৭৩ বছর বয়সে
তিব্বতের লাসা নগরের কাছে
চে-থঙের দ্রোলমা লাখাং
তারা মন্দিরে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ
করেন।
see the nex |
0 Comments