একদিনে ঘুরে আসুন কিশোরগঞ্জ হাওর

 

কিশোরগঞ্জ জেলার নিকলী, মিঠামইন, অষ্টগ্রাম ও ইটনা উপজেলার প্রায় সবটুকু এলাকাজুড়ে এই হাওর বিস্তৃত। এ হাওরের সৌন্দর্যে খুঁজে পাওয়া যায় গ্রামীণ পরিবেশের স্বকীয়তা। আর শহুরে জীবনে বেড়ে ওঠা তরুণ বন্ধুদের কাছে জানা-অজানার মধ্যে লুকিয়ে থাকা এমনসব জায়গাই সবচেয়ে আকর্ষণীয়।

বিশাল জলরাশির বুকে বিচ্ছিন্ন ছোট ছোট গ্রাম। যেন একেকটা ছোট ছোট দ্বীপ। হাওরজুড়ে গলা ডুবিয়ে থাকা হিজল গাছের সারি বা পানির নিচ থেকে জেগে ওঠা করচের বন কিংবা শুশুকের লাফ-ঝাঁপ মুহূর্তেই আপনার মন ভালো করে দেবে। কিশোরগঞ্জ হাওর এমনই।

নৌকা চলতে শুরু করামাত্রই হারিয়ে যেতে হয় জলরাশির রাজ্যে। দূর থেকে আরো যত দূরে চোখ যাবে, স্নিগ্ধ গ্রামের মতোই শান্ত অথৈ পানি প্রাণ জুড়িয়ে দেবে। জলের সীমানা শেষ হতেই যেন বিস্তৃত আকাশ। তারই মাঝখানে কিছু ঘরবাড়ি। নৌকার চালকদেরই বসবাস এখানে। মাছ ধরার সঙ্গেও জড়িত এ অঞ্চল।

এ হাওরের মাছ বিক্রি হয় প্রতিদিন শহরের বাজারে। কিন্তু তাদের মূল পেশা কৃষি। নৌকার মাঝির সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শুকনো মৌসুমে হাওর পরিণত হয় উর্বর মাঠে। নানা ধরনের সবজি চাষ হয় তখন পুরো সময়জুড়ে। বেশিরভাগ গ্রামের মতোই শিক্ষার হার এখানেও কম। নৌকায় ঘুরতে ঘুরতে শোনা যাবে গ্রামের শিশুদের মিষ্টি কণ্ঠে ভাটিয়ালি গান।

জেলেদের নৌকা, শিশুদের সাঁতার কাটা আর হাওরের মাঝখানে ছোট-বড় গাছ প্রায় বিলীন হয়ে যাওয়া বাংলার গ্রামের সৌন্দর্য চোখের সামনে ফুটিয়ে তুলবে। দিনশেষে হয়তো ফিরতে হবে আবারো শহুরে জীবনে। কিন্তু প্রতি বর্ষায় কিশোরগঞ্জ হাওর ভ্রমন বিলাসীদের মনে তৈরি করতে থাকবে আকাঙ্ক্ষা।

 

নিকলী ভ্রমণের উপযুক্ত সময়ঃ হাওরের পানির রূপ দেখতে চাইলে আপনাকে বর্ষাকাল বা তার পর পর যেতে হবে। তাই নিকলী ভ্রমণের উপযুক্ত সময় জুলাই – সেপ্টেম্বর মাস। তবে সেপ্টেম্বরে তুলনামূলকভাবে পানি অনেক কমে যায়। এছাড়া বছরের যে কোন সময়ই যেতে পারেন হাওরের ভিন্ন এক রূপ দেখার জন্যে।

নিকলী যাবেন যেভাবেঃ ঢাকা বা কিশোরগঞ্জ জেলার আশপাশ থেকে একদিনে ঘুরে আসতে পারবেন নিকলী হাওর থেকে। ঢাকা থেকে ট্রেনে বা বাসে করে নিকলী হাওরে যেতে পারবেন।

ঢাকা থেকে যদি ভোরে রওয়ানা করে রাতের মধ্যে চলে আসতে চান, তাহলে সবচেয়ে সুন্দর পন্থা হচ্ছে পুলেরঘাট দিয়ে যাওয়া। নিকলী হাওর সবচেয়ে বেশি কাছে হয় কিশোরগঞ্জের পুলেরঘাট থেকে। যেতে পারবেন ঢাকার সায়েদাবাদের পাশে গোলাপবাগ বাসস্ট্যান্ড থেকে ‘অনন্যা সুপার’ ও ‘যাতায়াত’ বাসে সোজা পুলেরঘাট। ভাড়া ২২০ টাকা। সময় লাগবে ৩ ঘণ্টা। পুলেরঘাট থেকে সিএনজি চালিত অটোরিকশা দিয়ে ১ ঘণ্টায় নিকলী বেড়িবাঁধ। সিএনজিতে জনপ্রতি ভাড়া ৮০ টাকা।

গোলাপবাগ থেকে একদম ভোর থেকেই বাস পাবেন। তবে ভালো থাকা-খাওয়ার চিন্তা করলে আপনাকে কিশোরগঞ্জ শহরেই যেতে হবে। নিকলী থেকে কিশোরগঞ্জ শহরে যেতে সিএনজিতে ঘণ্টাখানেক লাগে। আর যদি মনে করেন, কিশোরগঞ্জ শহর ও শহরের আশপাশে আরও কিছু ঐতিহ্যবাহী নিদর্শন যেমন ইশা খাঁর বাড়ি, চন্দ্রাবতীর শিবমন্দির, ঐতিহাসিক পাগলা মসজিদ, ঐতিহাসিক শোলাকিয়া ঈদগাহ ইত্যাদি ঘুরে আসবেন। তবে আপনি ঢাকা থেকে সরাসরি কিশোরগঞ্জ শহরে চলে যেতে পারেন। কিশোরগঞ্জ শহর থেকেই আবার যেতে পারবেন নিকলী হাওরে। রেলস্টেশনের দক্ষিণ পাশ  থেকে সিএনজি অটোরিকশা যায় নিকলীর দিকে। মাথাপিছু ৮০ টাকা ভাড়ায় মাত্র ১ ঘণ্টায় আপনি নিকলী হাওর বেড়িবাঁধে পৌঁছতে পারবেন।

অথবা শহর থেকে চলে যেতে পারেন শহরের খুব কাছেই চামড়াবন্দরে। সেখান থেকেও নৌকা ভাড়া করে ঘুরতে পারেন হাওরের আরেক পাশ। শহরের একরামপুর  রেলক্রসিং থেকে চামড়াবন্দরে যাওয়ার সিএনজি অটোরিকশা বা ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা পাওয়া যায়। সিএনজিতে সময় লাগবে আধা ঘণ্টারও কম। ভাড়া মাথাপিছু ৪০-৫০ টাকা।

কিশোরগঞ্জ হয়ে যেতে চাইলে-গোলাপবাগ বাসস্ট্যান্ড বা মহাখালী বাসস্ট্যান্ডে  ভোর থেকে সন্ধ্যার পর পর্যন্ত কিশোরগঞ্জের বাস পাওয়া যায়।

মহাখালী থেকে ছেড়ে যাওয়া কিশোরগঞ্জের বাসগুলো একটু ছোট টাইপের। অথবা ট্রেনে  যেতে পারেন। কিশোরগঞ্জে যাওয়ার সবচেয়ে আরামদায়ক জার্নি হচ্ছে ট্রেন। সারা দিনে তিনটি আন্তঃনগর ট্রেন ঢাকা-কিশোরগঞ্জ আসা-যাওয়া করে।

নৌকা ভাড়াঃ সাধারণত এক ঘণ্টার জন্য ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা নেয়। আবার কয়েক ঘণ্টার জন্য নিতে পারেন প্রতি ঘণ্টায় ৫০০ টাকার মতো করে। অবশ্যই ভাড়া দামাদামি করে নিবেন। এতে আরও কমতে পারে। নৌকাগুলো বেশ বড়সড়ও হয়। ১৫-২০ জন পর্যন্ত অনায়াসে নাচানাচি করে ঘুরে আসতে পারবেন। নৌকার সাইজ অনুযায়ী ভাড়া খুব একটা কমবেশি হয় না।

নিকলীতে খাবারের ব্যবস্থাঃ মূলত নিকলীতে ভালো মানের খুব বেশি খাওয়ার ব্যবস্থা নেই। তবে বাজারে বেশ কয়েকটা রেস্তোরাঁ আছে। মোটামুটি মানের তাজা মাছের রান্না দিয়ে খেতে ভালোই লাগবে। এছাড়াও বেড়িবাঁধে ঢোকার সময়ই একটা রেস্তোরাঁ পড়ে; সেই রেস্তোরাঁয় নদীর তাজা মাছের আঞ্চলিক স্বাদের খাবার খেয়ে নিতে পারেন।

যেখানে থাকবেন: কিশোরগঞ্জের বাইরে থেকে আসা অতিথিদের ভ্রমণ শেষে শহরে সার্কিট হাউজ বা কোনো হোটেলে উঠতে হবে। আর হাওরে রাতযাপনের জন্য নৌকাতেই অবস্থান করা সম্ভব। সেক্ষেত্রে অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয়রা নৌকাতেই রাত কাটাতে পারেন। কিংবা প্রতিটি উপজেলায় সরকারি ডাকবাংলোতে থাকার ব্যবস্থা রয়েছে।

 

হাতের কাছে আরেক রাতারগুলঃ হাওরে ঘুরতে ঘুরতে চলে যাবেন ছাতিরচরে। পানির নিচে ডুবন্ত এক সবুজ বন। লেয়ারে লেয়ারে সাজানো সুবজ গাছ। গাছের বুক বরাবর পানিতে ভাসতে থাকবেন আপনি। হুট করে দেখে আপনার কাছে মনে হতে পারে এটা আরেক রাতারগুল। নিকলী বেড়িবাঁধ থেকে নৌকায় সরাসরি ছাতিরচর যেতে ঘণ্টাখানেক সময় লাগে। নৌকায় ৩ ঘণ্টা ঘুরলে মোটামুটি অনেকটা জায়গা ঘুরে আসতে পারবেন।

 


0 Comments